শামীম আজাদ
শিরোনামহীন
আমার ভেতর কিছু একটা দগ্ধ হয়;
দগ্ধ সে জায়গা থেকে, উৎকট খুব উৎকট,
গন্ধ বেরোয়, শ্বাস-প্রশ্বাসে আমার।
চিন্তার মাঝে ঘুণ ধরে আর ঠিক তখন,
দৃষ্টিসীমায় কিলবিল করে অদৃশ্য পোকারা।
স্বত্ত্বা আমার, অশ্বথ গতিতে দৌঁড়ায় সেখান হতে,
পোকারা দৌঁড়ায় আরও বেশি তেজোদ্দীপ্ত!
ঝিম ধরে আসে আমার রক্তের গতিতে;
জমে গিয়ে যেন বরফ হই আমি।
আজব! সে পোকারাও স্থির হয়ে আসে;
তখন চিন্তারা উষ্ণতা ঢালে আমার ভেতর,
পুনরায় ছুঁটতে আরম্ভ করি প্রাণপণে,
পোকারা তখন আরও পরাক্রমশালী!
আমি আরও বেশি দগ্ধ হই, তখনো_
ভেতর থেকে আসে উৎকট গন্ধ।
অস্তিত্ব লোপ পেতে থাকে ধীরলয়ে,
পেরিয়ে যায় সময় অযুত নিযুতের ঘর,
একেবারে শূণ্যে পৌঁছাই আমি।
এবার রক্ত নয় পোকারাই সজীব করে আমায়!
রন্ধ্রে রন্ধ্রে দৌঁড়ায় তাদেরই ক্রিয়ার ফল,
চিৎকার করি সর্বস্ব দিয়ে প্রাণান্ত,
আশ্চর্য হই, ভীত হই, বুঝি; কেউ শোনেনা_
আমার চিৎকার। আমারই কানে বাজে;
মনে হয় প্রতিধ্বনির তোড়ে ফেটে যাবে_
নিজেরই কানের পর্দা, তবুও চিৎকার করি।
পোকারা দৌঁড়ায় আমার ভেতর, আমি পরাজিত হই;
শ্বাস-প্রশ্বাসে তখনও উৎকট গন্ধ,
যদিও আমি পড়ে থাকি গাছের গুড়ির মতন।
শিরোনামহীন-২
এই যে শীর্ণ রেখটা দেখতে পাচ্ছো,
এটা; স্বর্গ থেকে বিস্তৃত এখান অবধি!
এই রেখা ধরেই তুমি যেতে পারও স্বর্গে।
উজানে গেলে দেখবে বন্ধুর পথ,
ঢাল বেয়ে উঠে যেতে হবে উপরে,
খুব সন্তর্পণে, এখানে মরিয়া হওয়া বারণ।
এর গতিবিধি তুমি আঁচ করতে পাবে;
তবে দৃষ্টি দিতে হবে অপার মুগ্ধতা নিয়ে।
এখানে এসে থেমো দুদণ্ড,
কিছুটা বিস্মৃতি পাবে, পাবে কিছু সুখ,
হৃদয়ের অন্তিমে পাবে পুলক অদ্ভুত।
এর থেকে একটু ভাটিতে সমভূমি।
ঠিক এর অভ্যন্তরেই রয়েছে,
হাজার ব্যবচ্ছেদেও টিকে থাকা উর্বর ভূমি।
এই উর্বরতা দিয়েছে প্রাণ হাজারো_
বিকলাঙ বীজও উপ্ত হয়েছে কত কত কাল!
অথচ সময়ের ব্যবধানে সবচে দ্রুত,
ভুলে যাবে তুমি এই উর্বরতার দান।
এর থেকে নেমে গেলে ভাটিতে,
দেখবে ভূমি মুখ, হ্রদ, গিরিখাত,
এখানেই পাবে মাটির সোঁদা গন্ধ,
নাক সিঁটকানো বারণ এ গন্ধে;
এখানেই লুকিয়ে তোমার জাতিস্মর,
এর ধারায় যদি করতে পারও তপস্যা,
মিলবে সাঁই ঘুচবে অমাবশ্যা!
শিরোনামহীন-৩
ধুলো উড়বার কালে সব নীরব ছিল,
শ্বেতশুভ্র বসনে গড়ানো,
নারীর দেহই ছিল পড়ে নিথর,
এক টুকরো ভ্রম কোথা থেকে উড়ে,
ভাসিয়ে দিয়েছিল চরাচরে নিঃশব্দের ঝাঁপি,
আর ছিল অমীমাংসিত স্বপ্নের কেতন।
হাতছানি দেওয়া হাত হঠাৎই,
স্থির হয়ে গিয়েছিল তড়িৎস্পৃষ্ঠের ন্যায়,
কেউ দেখেনি চিবুক বেয়ে নীরবে,
ঘাম ঝড়েছিল ঝরঝর।
শেয়ালের ডাক থেমে গেছে তারপর,
আবহ থেকে গেছে আরও কতকাল,
হাতছানি দিতে ভুলে গেছে পৃথিবী,
এখানে এখন স্যাঁতস্যাঁতে ঘামের বসবাস!
জুলফিকার আলী
বাসন্তীর মানচিত্র
জাল জড়ানো শরীরে তার নেই কামনা
বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে ইতর সমাজ।
দুই চোখেতে আছে শুধু ক্ষুধার জ্বালা
অধিপতির মিছে মিছি দুঃখবিলাশ।
বিপন্ন এক কিশোরী যে ভোগ্য সবার
উঠছে ভরে রাতারাতি খাদ্য গুদাম।
ভাগ্যটা তো বড়ই ভাল অধিকর্তার
জাল পরিয়ে কর্তা পেলেন অতি সুনাম।
বস্ত্রটা কি জালের চেয়ে বেশি দামি!?
এই প্রশ্নের উত্তর তো কেউ বলেনা,
বিবেক সে তো নিলামেতে দামাদামি
নগ্ন দেহ বাসন্তী তাই বিশ্ব জানা।
বাসন্তীর ঐ বুকের ক্ষত আজও আছে
ব্রক্ষ্মপুত্রের বাঁকে বাঁকে দীর্ঘশ্বাসে।
মুখোশ
মুখোশের ঘূর্ণায়মান থাবায় প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হয় মানবিকতা।
বিনোদিনী মনের কাছে পরাজিত হয়ে-
বিশ্বাসের মহা-প্রাচীর ডুবে যায় অতল গভীরে।
ক্ষতবিক্ষত শরীর পরে থাকে তৃষ্ণার্ত জমিনে, জ্ঞানহীন লোভীর তৃষ্ণা মিটিয়ে।
মনের অজান্তেই- মনের মৃত্যু হয় ব্যক্তিত্বহীন খেয়ালী মনের কাছে।
মানুষ তো নয়- যেন পশুর সাথে পশু হয়ে করি বসবাস
পশুত্বের বলি হবে অচিরেই - এই তবু বিশ্বাস।
শহিদ রাসেল
আগুনের কোনো রং নেই
রাতের অন্ধকারে বসে আছি একা
হঠাৎ স্মৃতি নাড়া দিলো, কঠিন
উন্মুক্ত করে দিলো- ভবিষ্যতের অভয় চিত্র
কাতর আমি চোখ বন্ধ করলাম
স্মৃতিপুঞ্জ তাচ্ছিল্য করে জানান দিলো-
চোখের সক্ষমতা তাকে কখনো বিচলিত করে না
তৃতীয় চোখই তার সম-পথের অবিরাম সৈনিক
শেষে ভুলের মাশুল
তার অংশ বিশেষ
আমার দিকে এগিয়ে দিলো
আমি জ্বলিয়ে দিলাম সবকিছু
অবশিষ্ট ভস্ম আমার দিকে
করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কঠিনতম আমি অনুভব করলাম
অশ্রুসিক্ত নয়ন আর খেয়াল করলাম
আগুনের কোনো রং নেই
আগুন বেদনাময়ী, ভয়ঙ্কর।।
গন্তব্যে ভালোবাসা
আমি তো ভালোই অপেক্ষা করতে পারি
বাড়ি যাওয়ার পথে- গাড়ি হওয়ার অপেক্ষা
ক্ষিদে লাগা শরীরে- মন খাওয়ার অপেক্ষা
বন্ধ চোখে- স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা
নির্ঘুম রাতে- ভোরের জন্য অপেক্ষা
আমি তো ভালোই অপেক্ষা করতে পারি
আকাশ দেখে- উড়ে যাওয়ার অপেক্ষা
পাহাড়ের গায়ে- অবসরের অপেক্ষা
মেঠোপথে- গ্রামীন হওয়ার অপেক্ষা
বর্ণমালায়- রংধনু পড়ার অপেক্ষা
পাখির চোখে- মানুষ দেখার অপেক্ষা
আমি তো ভালোই অপেক্ষা করতে পারি
হাতের কোলে হাত রেখে- কথা হওয়ার অপেক্ষা
চোখের সাথে হাসি রেখে- জীবন বলার অপেক্ষা
ভালোবাসার প্রেমিক দ্বীপে- রামলীলার অপেক্ষা
ভুলে যাওয়ার খুনসুটিতে- সৃজনলীলার অপেক্ষা
হারিয়ে দিয়ে- পুরস্কারটি উৎসর্গ করার অপেক্ষা
অপেক্ষা করতে পারি-
কথা দেয়ার পাণ্ডুলিপি প্রকাশনার অপেক্ষা।।
নীরার জন্য ভালোবাসা (২)
সময়ের করাত কলে
খন্ডিত জীবন যেনো রক্তাক্ত দুপুর
শুকনো পাতার মতো চিলেকোঠা
আকাশের মেঘ দেখে
মনের জানালা সাজে সাত রঙে
সূর্য থেকে নেমে আসে নরোম রোদ
এলার্ম ঘড়িতে ভেসে ওঠে
অফিসের প্রবেশদ্বার
বসার ঘর নেই, নেই চেয়ার
পুরো রাজ্যে চালাতে হবে তরবারি
অষ্টপ্রহরে বাসায় ফেরার তাড়া নেই
মনের মানুষ তেরো নদীর ওপারে
বৈঠা হাতে মাঝি, মিলনের সুর
আমাদের আকাশ দেখার
নেই তো অবসর,
আবছা হয়ে আসে
মেঘের ভেলা, ফুল ও বিছানা বাসর।
হাসনাত জিলান কাব্য
তোমাকে চাই
পুরাতন হয় বোঝাপড়া; আঁকড়ে ধরে শিকড়।
এক মুহূর্তে প্রেম আসে- পবিত্র বাঁধন আসে,
তারপর শেষ নিঃশ্বাসও কেটে যায় বুঝতে-বোঝাতে।
সাত আসমান-সাত জনমের আমি
প্রতি বেঁচে থাকায় তোমাকে চাই।
সাত সমুদ্র-সাত রঙের বয়ে চলায়
স্বার্থপরের মত মৃত্যুতেও তোমাকে সঙ্গী করতে চাই।
পেয়েছি যা; দেয়া হয়নি কিছুই
অর্থ মানে তোমায় জানি আমি।
যত্ন করে ঠাঁই পেয়েছে সুখ
সম্পদ মানে তোমায় বেঁধেছে বুক।
অন্ধকারের কালো হাতের ছায়া,
দুমড়ে যাক সকল অশুভ মায়া।
তুমি-আমি খুব সহজে সাধারণ,
রুখে দিব সমস্তপ্রকার গ্রহণ।
শত রূপে ঘুরবে জামানা,
আমি তোমায় জীবনে চাই;
তুমি আমায় মরণের প্রার্থনাতেও নাও গো প্রিয়তমা।
বাবা এবং মানুষ
একদিন আমি মানুষ হবো
স্মরণ সভার উক্তিতে হারিয়ে যাবে তাঁর নাম।
একদিন আমি বাবা হবো,
তারপর অবান্তর।
রাতের আঁধারে মাথায় বুলনো হাত,
প্রকাশে আছে মোজাইকে জমা চক বর্ণের ছাপ।
কিসের প্রণয়-কিসের প্রেম?
নতজানু সব; ঘামের দামে ঠোঙ্গা ছুঁয়ে।
মহাপুরুষের খোঁজে যখন আমি বইয়ের পাতায়,
তখন তিনি আমার নামে কামার পাড়ায় শরীর পোঁড়ায়।
আমি কিন্তু সত্যিই বড় হবো,মানুষ হবো
বাবা আমার আঁট বেঁধে যায় রোদন ভেলায়।
শহীদুল ইসলাম অর্ক
জোকার
জীবনজুরে এক অমোঘ মিথ্যাচার,
ভুল স্বপ্নের বেসাতি।
বস্তুত জোকার, একঘেয়ে মুদ্রায় বাঁচি
নিত্যদিন অভিন্ন অপেরায়!
অ্যালার্জি
ধুলো হচ্ছে রূপান্তরিত কংক্রিট, পাথর। মিলিয়নস অব
অ্যালার্জেন! কংক্রিট ডানাহীন কিন্তু ধুলো উড়ন্ত!
তাই গর্ব করার কিছু নেই, বোকা মানুষ। উড়ছ খুব!
হাজরে আসওয়াদ থেকে নেমে এসেছ ধুলোয়, তুমি
সভ্যতার অ্যালার্জি!
নিঃসঙ্গতা
পালিশ করা জুতো যায়।
চামড়ার চটি যায়।
হাই হিল যায়।
ফ্ল্যাট জুতো যায়।
কেডস-জোড়া যায়।
পাম সু যায়।
বুট জুতো যায়।
শুধু এক জোড়া সস্তা স্যান্ডেল
রুমের বাইরে দরজায়
পড়ে থাকে কী-জানি কী শঙ্কায়!
0 Comments