Ticker

6/recent/ticker-posts

জীবনের 'লেট' গাড়ি



সেই কবে জীবন শুরু হয়ে ছিল,মনে নেই , তবে মায়ের মুখে শোনা যে,ষাঠের দশকে আমার জীবনের শুরু হয়েছিল কিছু আগে,মানে হল আমি ছিলাম প্রিম্যাচিওরড বেবি, তার মানে ওই একবারই 'লেট' হয় নি।কদিন হাসপাতালের বিশেষ কুঠুরীতে রাখতে হয়েছিল আমাকে,আজকাল যার পোষাকী নাম নিওনাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা সংক্ষেপে নিকু।

কিন্তু সেই যে পথ চলার শুরু,তার পর শুধুই 'লেট' বা দেরীরই ইতিহাস।মনে পড়ে একবার আমার যখন দশ এগারো বছর বয়স ,তখন আমাদের দার্জিলিং যাওয়া হয়েছিল মায়ের স্কুলের দিদিমনিদের সঙ্গে।সেখানে দার্জিলিং ,কালিম্পং দেখে আবার আমাদের পরের গন্তব্য ছিল গুয়াহাটি , শিলং ও চেরাপুঞ্জী। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেসে চড়ে যাব গুয়াহাটি।কিন্তু বিকেল বিকেল ট্রেনে চড়ে  ওই বেলাকোবা না কি একটা স্টেশনের পর সন্ধ্যের যখন হব হব,তখন গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।সামনের কোন ট্রেন নাকি লাইনচ্যুত হয়ে  লাইনের ক্ষতি হয়েছে, তাই গাড়ি চলতে পারছিল না।সেই অন্ধকার রাত আমাদের ট্রেনেই কাটাতে হল এক অজানা জঙ্গল প্রান্তে।সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। রাতের সেই অজানা অচেনা বিভিন্ন রকমের আওয়াজ ,রাত যেন আর শেষ হতে চায় না। তারপর প্রায় বারো চোদ্দ ঘন্টা এই ভাবে জঙ্গলে কেটেছিল।তারপর লাইন মেরামত করে বিপত্তি কাটিয়ে পরদিন সকালে শুরু হয়েছিল ট্রেন চলাচল। এই বিপত্তির সময় ট্রেনে হয়েছিল জল ,আলো, স্যনিটেশনের চরম অব্যবস্থা। এরপর ট্রেন যখন চলতে শুরু করল তখন আর সময়ের নির্দিস্ট নিয়মকানুন না মেনেই চলছিল ট্রেন।যখন বঙ্গাইগাঁও এল তখন আমি ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে  জল আনতে নামলাম।ওমা! বোতলে জল ভরতে না ভরতেই ট্রেন দিল ছেড়ে,আসলে ট্রেন তখন তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে চাইছে ,তাই সময়ের আগেই দে ছুট্।কোন মতে চলন্ত ট্রেনে উঠতে পেরেছিলাম, ওদিকে গাড়ির ভেতর থেকে মা ও মাসীদের ওই 'গেল গেল' রব। সে যাত্রা ভ্রমণ ভালই হয়েছিল।


আর একবার আমি আর মা যাচ্ছিলাম মামাবাড়ি জবলপুরে। দুপুরে বোম্বে মেল ভায়া এলাহাবাদে চড়ে এলাহাবাদ পার করার পর যখন শংকরগড় এল এক বিরাট ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। ট্রেনের সামনের কয়েকটি বগি নাকি লাইনচ্যুত হয়েছে।লাইন সারাতে লেগে গিয়েছিল  কয়েক ঘন্টা। পরদিন ভোরে জবলপুরে নামতে হয়েছিল  প্রায় বারো ঘন্টা পর।গরম কাল ছিল, তাই সেই সময়টায় দেখা দিয়েছিল চরম জল সমস্যা।কোন স্টেশন না হওয়ায় জল নিয়ে শুরু হল অনভিপ্রেত বচসা  সহযাত্রীদের মধ্যে।দেখেছিলাম একবাড়ির ,মানে দুই জায়ের মধ্যে কে বেশি জল খরচ করেছে তাই নিয়ে দোষারোপ একেবারে চুলোচুলির পর্যায়ে পৌছল।দেখেছিলাম মানুষ যখন অকারণে হেল্পলেস অবস্থায় পড়ে তখন কেমন দিকভ্রান্ত হয়ে অদ্ভুত আচরণ করে।


আবার উনিশশো চুরানব্বইএ আমার বিয়ের অষ্টমঙ্গলার পরদিন হানিমুনের জন্য আমরা যাব গ্যাংটক।আমার এক দাদা সেই যাত্রার যাবতীয় খরচ স্পনসর করেছিল।কোন পরিচিত ট্রেনের রিজর্ভেশন না পাওয়ায় আমাদের টিকিট হয়েছিল ত্রিবান্দ্রম-গৌহাটি এক্সপ্রেসে, যাব নিউ জলপাইগুড়ি।আমার শ্বশুরমশাই তো আমাদের এক ট্যাক্সিতে চড়িয়ে দিলেন হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে।দুপুরের সেই ট্রেন 'লেট' করে এসে ছিল রাত তিনটেতে।আমরা পুরো সময়টা কাটিয়েছিলাম হাওড়ার প্রথম শ্রেনীর বিশ্রামাগারে। এই হাওড়া স্টেশনের জনসমুদ্রে আমরা নববিবাহের পর কেমন যেন অনন্য একা একা কাটিয়েছিলাম  দুজনে।সেই কয়েক ঘন্টা যে কখন কেটে গিয়েছিল কে জানে, বুঝতেই পারিনি।
একবার হল কি , আমার শিলিগুড়ি যাওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু কোন টিকিট পাচ্ছিলাম না।তাই  সল্টলেকের করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডে রয়েল ক্রুইসার ভলভো বাসে চড়লাম রাত সাড়ে আটটায়।কিন্তু কপালের ফের যায় কোথায়? তাই পরদিন সকাল সাতটায় যার শিলিগুড়ি ঢোকার কথা সেই বাস পৌছল বিকেল পাঁচটায়,কৃষ্ণনগর  আর ডালখোলার জ্যামে আটকে,পরেরদিনের সব প্রোগ্রাম ওলট পালট করে দিয়ে।


ভারতীয় রেলে আর বঙ্গীয় পরিকাঠামোয় দু পাঁচ ঘন্টা দেরী 'নরমাল' এর মধ্যেই পড়ে,তাই  সেই রকম অজস্র আরো 'লেট' এর অভিজ্ঞতা গুলো এই বিবরণের বাইরেই রাখলাম।


তবে জন্ম একটু তাড়াতাড়ি হলেও আজ ছাপ্পান্নোর্ধ এই জীবনে মনে হয় , এখনো তো অনেক কিছুই দেখা বাকী থেকে গেল, হল না অনেক রূপ, রস, গন্ধ আস্বাদন। তবে  শেষের সে দিন যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন আরও একটু 'লেটেই' চলুক না এই জীবন গাড়ী॥

Post a Comment

0 Comments