লিখে যাও কবিতাটা - লিখছো না কেন ?
-কিসের কবিতা ? শুনলুম 'শোণিত পুরাণ ' নাটক হচ্ছে ডাক বাংলোয় । কী এমন আছে ওই নাটকে ! হয়ত গণহত্যার কথাই লেখা থাকবে ওতে । কি আর গল্প লিখি -
এটা কি স্বাধীনতার কল্প কবিতা ?
কাসেম ব্যপারী চাচার সুপোরী বাগান ঘেসে আঁকাবাকা হয়ে বয়ে গেছে বুড়িতিস্তা। উত্তর পশ্চিম দিকটা তখন ফাঁকা মাঠ । বুড়িতিস্তার তীরঘেষা সেই পথটাও এঁকে বেঁকে গেছে ডাক্তার পাড়া হয়ে তেলী পাড়ায়। আরেকটা পথ খামারগ্রাম হয়ে পিয়াদাপাড়া । তখন আমরা ক'জন দুরন্ত দামাল কিশোর । সবার হাতে লালসবুজ পতাকা। চাচার বাগান থেকে পতাকা ঘাড়ে নিয়ে সে কি দৌড় !
গুলুদাহ পেরিয়ে মাঠভরা হলুদ শর্ষেক্ষেত সবুজ কলাই - মাঝে মধ্যে ইটাক্ষেত ।
আমরা সবাই অবাধে দৌড়াই - ভোঁ দৌড়, বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ি কখনো সবুজ কলাই ঘাসে, শর্ষেখেতে কখনো ইটাবাড়ী। আনন্দ আবেগে !
সেদিন কবি সামাদ চাচাও ছিলেন আমাদের সাথে ,
প্রানোচ্ছল এক গ্রামীন কবি সামাদ চাচা ।
তুখোরকণ্ঠ, অথচ সরলভাবে অনর্গল কবিতা শোনাতেন, স্বাধীনতার কবিতা ।
হৈহুলোরে মেতে - সড়ক পার হয়ে এসে দাড়াই
পাগলাকুড়ার মাঠে - এক বিশাল বৃক্ষের নিচে ।
অচিন গাছ -নামটাও অজানা, কবে কে বুনেছিল এর বীজ কেউ জানেনা। সুবিশাল ছাতার মত ডালপালা ছড়িয়ে মমতায় ছায়া দিচ্ছে কত বছর ধরে - কে জানে ?
উত্তরের কবরস্হানটি তখন ছিলনা ওখানে - ছিল কাঁশখেত, বাঁশের ঝাড় , জোনাক পোকা, রাতে, শেয়ালের হুক্কাহুয়া। কচুরিপানা ভর্তি পাগলাকুড়ার বিল, নীলাভ সাদা ফুলে ছাওয়া ।
যুদ্ধ শুরু শুরু ।
কবি চাচার কন্ঠ মিলিয়ে সমস্বরে গাইছি , আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায়.....
কোরাস গাই সবাই মিলে - জল্লাদ ইয়াহিয়াকে খতম করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো,
টিক্কাখান নিপাত যাক,
বাংলাদেশ মুক্তি পাক........।
যুদ্ধ শুরু হলো বু্ঝি
পাগলাকুড়ার মাঠের সড়ক দিয়ে ছুটছে সারিবাঁধা মানূষ । বকুলতলার বাঁক ঘুরে
বাকরের হাট, দলদলিয়া, নাাজিমখাঁন হয়ে রাজার হাটে যাবে ।
তারপর ?
পাংগা রাজবাড়ী, বড়বাড়ী ... ধরলার কুলাঘাট, তারপরে ভারত ।
মনে হচ্ছে চিলমারীর ব্রম্মপুত্রে অস্টমীর স্নান শেষে ফিরছে সবাই। মানুষের ঢল, দলেদলে - ওরা যেন উল্টোপথে হাঁটছে, দেউলাবিলের সিঁদুরমতি দীঘি, যেন মেলা বসবে, অষ্টমীর মেলা ।
মানুষ চলছে শুধু মানুষ, উদ্বেগ উৎকন্ঠায়- পায়ে হেঁটে পিঁপড়ার সারির মত।
কেউবা গরুর গাড়িতে, সিঁথিতে সিঁদুর আঁকা বধুর - অজানা ভয় তাড়িত করে !
যত দ্রুত সম্ভব যেতে হবে ভারতের দিনহাটায় - কোচবিহারে- আলীদুয়ারপুরে ।
বন্ধু ধন্জয়, ধনা, রামকৃষ্ণ তিলক চপল হয়ত: চলে গেছে আগেই।
পান্ডেরাও চলে গেছেন সম্ভবত: গবাদা, রথীন পান্ডের বাবা কাকা সৌমেনবাবু, দ্বিজেন পান্ডে । সাংস্কৃতিক অংগনের পুরোধা ছিলেন, সেই নিমাই, গগ, অজিতবাবু, যাত্রা দলের নিবিড় পরিচর্যা করতেন । কানুবাবু আমার প্রিয় শিক্ষক, অনর্গল কাঁচা শুপোরি চিবোতেন । ক্লাশে পড়া নাহলে তালপাতার পাখা হাতে জোরে মারার ভান করে আস্তে ছুঁইয়ে দিতেন পিঠে । আমরা পিঠ বাঁকা করে হাসতাম। কানাইলাল সরকার সত্তরের এমপি - টকটকে ফর্সা সাদা সিধে নিরীহ মানুষ । ফার্নিচারের ব্যবসা ছিল সে আমলেই । ভেলুবাবুদের বংশধারা ভুটু- ভগত, পার্থ দা।
মাঝিপাড়ার জেলেরা, বেহারারা, নাপিতপাড়ার শীলেরা, বাজারের পশ্চিমারা, বোস, দত্তবাবু...
কোচপাড়ার কোচেরা - সবাই হয়ত চলে গেছেন ।
শুনলুম-
মুকুল ডাক্তার পথে আটকে গেছেন, বড় নিরীহ মানুষ বেচারা - ছোট্ট তিনটে শিশু বাচ্চা । বৌদির নিস্পাপ দু'টোচোখ, উৎকন্ঠায় ভরা। আশ্চর্য্য ! এ মানুষ টা এখানে কেন ! কারা এনেছে পথ ভুলিয়ে এভাবে ? শুনে বাবা বললেন, ওরা আমাদের পরশীর মত । অনেক ওষুধপত্র কিনেছি ওঁর দোকানে- বিপদে আপদে, বড় ভাল মানুষ ছিলেন তাঁর বাবা ডা: অনাথবন্ধু । সুসম্মানে যেতে দাও তাঁকে নির্ভয়ে নিরাপদে ।
ক্ষতি যেন হয়না কোনো ।
....ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে বোমারু বিমান।
আকাশটা ধোঁয়ায় ছাওয়া । বিমান দেখে বাবা গল্প শোনাতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধজাহাজ আর মানুষের মৃত্যুর গল্প । নজরুলকে ভাল বেসে অনুকরণ করেছি বাবরী চুলের । সবাই আতংকে শাসায় - কেটে ফেল। মিলিটারির হাতে মারা পড়বি। কিশোর দৌড়াত্ব আমার - নাহ, দেশটা স্বাধীন হোক আগে।
দ্রিমদ্রিম দিমাদ্রিম টরে টরে টক টক টাকডুম টাকডুম - বিকট শব্দ ।
মরতে মরতে জীবনটা অল্পের জন্য বেঁচে গেলো বুঝি ! আকস্মিক হাটের মাঝে গোলাগুলি । হাটুরীদের পশরা যে কোথায় গেল আলু বেগুন পটল মরিচ পিয়াঁজ ! পালাও পালাও । অকস্মাৎ গুলির শব্দে পড়ি মরি ভীমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে হাটুরেরা ।
পালাও পালাও প্রান বাঁচানোর অদম্য চেষ্টা সবার । বড় বাসার সামনে বড় ইঁদারা ছিল । শুনেছি ওটির ভিতরে লাশের 'পর লাশ ।
গাঁয়ে একটাই দু'ব্যান্ড রেডিও ছিল, জয়নাল ভায়ের । জাবেদ ভায়ের মাচানে বসে উৎসুক চিত্তে রেডিও শুনতাম - আকাশবানী কোলকাতা - শিলিগুড়ি - শিলং। বিবিসি লন্ডন, ভয়েস অব আমেরিকা । স্বাধীনবাংলা বেতার শুনে মনটা উৎফুল্লে ভরে যেত । সন্ধ্যায় শ্রমকাতর মানুষ খড়ের পাকানো ভুতির ধোঁয়ায় মশা তাড়িয়ে নিশ্চুপ বসে শুনতেন, কখনো আবৃত্তি চলতো - আমার কিশোর কাঁচা কন্ঠে স্বাধীনতার কবিতা ! ছবি আঁকতাম- রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধার ছবি ।
মনে পড়ে - হাট থেকে ফিরি হাফাতে হাফাতে । আমরা ছিলাম তখন পাট হাটিতে - বাবা যে জন্যি দু''ধরা পাট মাথা থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন আমার পিঠের দিকে। বাবার মাথায়ও ছ'ধরা- বিকোতে এনেছেন আমাকে সাথে নিয়ে । পড়ি ত মরি- বাবার সাথে আমিও দৌড়াই... চো ও ও ও..ও. ছড়াৎ ছড়াৎ গুলি মাথার উপর দিয়ে ছোটে । জুম্মা পাড়ার কাছ দিয়ে দৌড়ে সোজা
বুড়িতিস্তার একবুক পানি পার হই ।
নবীজানের ঘাড়ে গুলি বিঁধেছে ।পাড়ায় কান্না কাটি চলছে ওকে ঘিরে । না, ক্ষতি হয়নি তেমন ওর চুলের খোঁপায় এসে আঁছড়ে ড়েছে বুলেট ।
শুনলাম, মকবুল ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে । ভাগ্যটা ভাল কিভাবে যেন ছাড়া পেলেন আবার ।
সন্ধ্যায় জুড়ান মামা খোঁজ নিতেন প্রতিদিনের খবর, যুদ্ধের কি হল, কতজন পাক সেনা আটক হল আজ। মারা পড়লো ক'জন, মজা করে মামা ব্রিটিশ তাড়ানোর কাহিনী শোনাতেন । দেখো- পাকসেনারা হেরে যাবে । ব্রিটিশরাও টিকতে পারেনি এদেশে । তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তায় সাহস খুঁজে পাই। খুবই কম শুনতেন - কানে মুখ লাগিয়ে বলতাম -হ্যাঁ, ওরাও হেরে যাবে মামা , ঠিকই বলেছেন, মামা হাসতেন ।
একদিন যাদুপোদ্দার গ্রামে কাসু তালুকদার চাচার বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিল ওরা । রেললাইনের পুর্বদিকটাই ছিল ঝুকিতে ভরা, কারণ ওদিকে ভারত, মুক্তিযোদ্ধার ভয়টা ওদের ওদিকেই বেশী ।
হাতিয়ায় গণহত্যা চালালোে নির্মমভাবে । নির্দয় ভাবে বাড়ী ঘরে আগুন দিল অনেকের ।
তারপর ন, ন'টা মাস গেল......সে অনেক কাহিনী ।
বলার ভাষা নেই।
চার ডিসেম্বর বিকেল । রেল ষ্টেশনে গিয়ে দেখি ডাক বাংলোর কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাড় গোর, করোটি , দাঁতের চোয়াল , রক্ত মাখা শার্ট, ছিন্নভিন্ন বস্ত্র , অসংখ্য খানা খন্দক, গর্ত, লোকেরা সব বলাবলি করছে - এসব গনকবর !
এগুলোর মধ্যে একটি করোটির দাঁত দেখে চিনেছিলেম জোনাইডাঙার আজগর কি আকবর আলী - বাজারে রেডিও মেকারী করতেন । স্কুল পালিয়ে আমাদের আড্ডাটা ওখানেই জমতো তাঁর দোকানে - মেকারী দেখতাম- সাথে শুনতাম রেডিওর গান । সেই মেকানিকস ভা'য়ের চোয়াল করোটি । ওধারে একজনের তো হাতের আঙূল কটা বেড়িয়ে আছে মাটির উপরে কব্জি তক ।
আজ সকালেই আর্মিরা পালিয়েছে - রেখে গেছে বিভৎস চিহ্ন সব ! আহ কী যে নৃসংশতা ! শান্তনার হিসাব মেলেনা আমার -
নিরাপরাধ বাঙালীদের জীবন দিতে হল - এতো হিসাব মিলবে কোথায় ?
অনেক অংক করি - অ- নে -ক ।
এত রক্ত, এতপ্রান এত সম্ভ্রম গেল, এর হিসাব কেন আজো
মিলছে না আমার !
0 Comments